গায়েব নথির হদিস নেই, ফাঁস হলে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে বিমান

দুই কর্মকর্তা লাপাত্তা

গায়েব নথির হদিস নেই, ফাঁস হলে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে বিমান

প্রথম নিউজ, ঢাকা: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আনোয়ার হোসেন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দিব্যি অফিস করেন। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে কাউকে কিছু না বলে বের হন অফিস থেকে। হেঁটেই চলে যান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ বিমানের বিজি-৩০৫ ফ্লাইটে। পরে নির্ধারিত সময়ে পাড়ি জমান কানাডার টরন্টোতে।

এ ঘটনা গত বছরের ২৪ অক্টোবরের। এই কর্মকর্তার হঠাৎ এমন বিদেশ সফরের খবর প্রকাশের পর আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। কারণ, তার শেষদিন অফিস ত্যাগের পর থেকে বিমানের গোপনীয় বিভিন্ন এগ্রিমেন্ট, আরআই পলিসি ও সফটওয়্যার সম্পর্কিত স্পর্শকাতর নথিপত্রের হদিস মেলেনি। এখন পর্যন্ত এসব নথিপত্র উদ্ধার করা হয়েছে কি না, তা-ও স্পষ্ট নয়।

আনোয়ার হোসেনের দেশত্যাগের পর থেকেই কর্মস্থলে অনুপস্থিত বিমানের আরেক কর্মকর্তা সোহান আহমেদ। তিনি বিমানের বাণিজ্যিক তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগসাজশে তারা দুজনই বিমানের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র গায়েব করেছেন।

ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে বিমান কর্তৃপক্ষের গাফিলতি রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন অন্য কর্মকর্তারা। তাদের অভিযোগ, দুই পলাতক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না বিমান। ঘটনার পর তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হলেও তদন্তকাজ চলছে ধীরগতিতে। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থাও নিচ্ছে না সংস্থাটি। শুধু দায়সারাভাবে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। কিন্তু সে জিডিরও কোনো তদন্ত করছে থানা পুলিশ।

তবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি তদন্ত করছেন। এরই মধ্যে আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। সোহান আহমেদের বিরুদ্ধে তদন্তও শেষ পর্যায়ে।

জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) আল মাসুদ খান  বলেন, ওই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পলাতক দুই কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন ও সোহান আহমেদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। এরমধ্যে আনোয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র চূড়ান্ত হয়েছে। সোহানের বিরুদ্ধে তদন্তও শেষ পর্যায়ে। ঘটনার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিতে বিমান সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রাথমিক তদন্তে আনোয়ার হোসেনকে বিদেশে পালাতে সহায়তার দায়ে বিমানের আরেক কর্মকর্তা উপ-ব্যবস্থাপক তারেক মাহমুদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনার নেপথ্যে আরও যাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল, তাদের খোঁজও নেওয়া হচ্ছে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের ২৪ অক্টোবর সকালে যথারীতি কর্মস্থলে যান আনোয়ার হোসেন ও সোহান আহমেদ। এরপর আনোয়ার হোসেন বিকেলে কাউকে কিছু না বলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ বিজি-৩০৫ ফ্লাইটে পাড়ি জমান কানাডার টরন্টোতে। ওইদিন তার অফিস ত্যাগের পর থেকেই লাপাত্তা প্রতিষ্ঠানটির বাণিজ্যিক তত্ত্বাবধায়ক সোহান আহমেদও। পরে তাদের খোঁজ না পেয়ে রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর ৬৭৭) করেন প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তা বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. মাছুদুল হাছান। শুরুতে ঘটনাটি অনেকটাই ধামাচাপা ছিল। গত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি তা প্রকাশ হয়। তখন কিছুটা নড়েচড়ে বসে বিমান।

পরে এ ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে বিমান জানতে পারে, আনোয়ার হোসেনকে কানাডায় পালাতে সহায়তা করেছেন বিমানের আরেক কর্মকর্তা তারেক মাহমুদ। তিনি বিমানের উপ-ব্যবস্থাপক (গ্রাউন্স সার্ভিস এয়ারপোর্ট সার্ভিসেস) হিসেবে কর্মরত। এর দায়ে তাকে গত ৭ ফেব্রুয়ারি এক অফিস আদেশের মাধ্যমে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শফিউল আজিমের সই করা ওই অফিস আদেশে বলা হয়, আনোয়ার হোসেন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই গোপনে বিজি-৩০৫ ফ্লাইটে কানাডায় চলে যান। আর প্রশাসনিক আদেশ নম্বর ২৩/২০০৫ অনুযায়ী শাখা প্রধানের অনুমোদনের পর সংশ্লিষ্ট অ্যাডমিন সেলের ইনচার্জ উত্তরণ কর্তৃপক্ষের ফর্মে অনুমোদন কলামে সই করার কথা। কিন্তু উপ-ব্যবস্থাপক তারেক মাহমুদ বিধিবহির্ভূতভাবে এবং বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি ব্যতিরেকে আনোয়ার হোসেনের টরেন্টোর উত্তরণ কলামে কর্তৃপক্ষের ফর্মের অনুমোদনে সই করেন এবং অবৈধভাবে টিকিট প্রাপ্তিতে সহায়তা করেন।

এ সুযোগে আনোয়ার হোসেন গোপনে কানাডায় চলে যান। তারেক মাহমুদের এমন কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ বিমান করপোরেশন কর্মচারী (চাকরি) প্রবিধানমালা, ১৯৭৯-এর ৫৫ ধারা অনুযায়ী অসদাচরণের শামিল এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই বাংলাদেশ বিমান করপোরেশন কর্মচারী (চাকরি) প্রবিধানমালা, ১৯৭৯-এর ৫৮ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তারেককে চাকরি থেকে সাময়কি বরখাস্ত করেছে বিমান। আনোয়ার হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে বিমান কী উদ্যোগ নিয়েছে; দেশে আত্মগোপনে থাকা আরেক কর্মকর্তা সোহান আহমেদের বিরুদ্ধে বিমান কী ব্যবস্থা নিয়েছে, প্রশ্ন উঠেছে এ বিষয়গুলো নিয়েও।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড বিমানের সুনামহানি করেছে। যেসব গোপন নথিপত্র গায়েব হয়েছে, তা যদি প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো এয়ারলাইন্সের কাছে চলে যায়, তবে বিমান আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতসব ঘটনার পরও বিমানের তেমন কোনো পদক্ষেপ বা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। থানায় যে জিডি করা হয়েছে, তার তদন্তেরও কোনো অগ্রগতি নেই।

জানতে চাইলে বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইয়াসির আরাফাত খান বলেন, বিমানের ওই দুই কর্মকর্তার বিষয়ে থানায় যে জিডি করা হয়েছিল, আমরা তার তদন্ত করেছি। তবে তদন্তে এখন পর্যন্ত কী ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারেননি ওসি ইয়াসির।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে শনিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পুলিশের বিশেষ পুলিশ সুপারের নির্দিষ্ট মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল করলেও রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন করা হলেও তিনি দেখেননি।