চিকিৎসায় সর্বোচ্চ ব্যয় ঢাকায়, সর্বনিম্ন ময়মনসিংহে
দেশে চিকিৎসা খাতে মোট খরচের ৩৭ ভাগ ঢাকা বিভাগে, যা সর্বোচ্চ। আর ৩ ভাগ ময়মনসিংহে, যা সর্বনিম্ন।

প্রথম নিউজ, অনলাইন : দেশে চিকিৎসা খাতে মোট খরচের ৩৭ ভাগ ঢাকা বিভাগে, যা সর্বোচ্চ। আর ৩ ভাগ ময়মনসিংহে, যা সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের (বিএনএইচএ) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে বিএনএইচএর ষষ্ঠ রাউন্ড ফল অবহিতকরণ সভা থেকে এ তথ্য জানানো হয়। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস সেলের ফোকাল পারসন ডা. সুব্রত পাল ষষ্ঠ রাউন্ডের ফলাফল জানান।
তিনি বলেন, বিভাগওয়ারি চিকিৎসা খাতে খরচের হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, মোট খরচের ৩৭ ভাগ করা হয়েছে ঢাকা বিভাগে, যা সর্বোচ্চ এবং ৩ ভাগ ময়মনসিংহে, যা সর্বনিম্ন। মাথাপিছু হিসেবে চিকিৎসা খাতে ঢাকা বিভাগের জনপ্রতি ব্যয় করা অর্থের পরিমাণ ৭ হাজার ৩৯ টাকা এবং ময়মনসিংহে ২ হাজার ৬০ টাকা। সর্বোপরি ২০২০ সালে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যের জন্য গড় মাথাপিছু ব্যয় ৪ হাজার ৫৭৮ টাকা। ডা. সুব্রত পাল বলেন, ২০২০ সালে ব্যক্তিপর্যায়ে ব্যয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে মোট চিকিৎসা ব্যয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ) সম্পন্ন হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা কর্তৃক ব্যয়ের পরিমাণ ৫ শতাংশ। এর আগে প্রকাশিত বিএনএইচএর তথ্য অনুসারে ২০১৫ সালে মোট চিকিৎসা ব্যয়ের মধ্যে সরকারি খাতের ব্যয় ছিল ২২ দশমিক ৮ শতাংশ, যা ২০২০ সালে সামান্য বেড়ে ২৩ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়ায়।
তিনি জানান, ব্যক্তির পকেট থেকে ব্যয় সবসময় সরকারের ব্যয় বা সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, মোট নিজ পকেট থেকে ব্যয়ের ৫৪ শতাংশ খরচ করে থাকে দেশের শীর্ষ ধনী জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর নিম্ন দুই ভাগ মোট নিজ পকেটের যথাক্রমে ৪ শতাংশ এবং ৮ শতাংশ খরচ করে থাকে। চিকিৎসার ব্যয় বিশ্লেষণে আরও দেখা যায় যে, জনসংখ্যার সর্বনিম্ন অংশ মাথাপিছু ২০০ টাকা নিজ পকেট থেকে ব্যয় করে থাকে। যেখানে জনসংখ্যার শীর্ষ ধনী অংশ খরচ করে এর তুলনায় আটগুণেরও বেশি টাকা (১ হাজার ৭১৪ টাকা)। একই এলাকা বা গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে মাথাপিছু খরচের তুলনায় দেখা যায় যে, সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলো দরিদ্রদের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি ব্যয় করেছে।
ডা. সুব্রত পাল জানান, গ্রামাঞ্চলে শীর্ষ দুই ধনী অংশ খরচ করে মোট ব্যক্তি পর্যায়ে খরচের ৫৭ শতাংশ, যেখানে দরিদ্রতম দুই অংশ খরচ করে ২৫ শতাংশ। কিন্তু শহরাঞ্চলে এ খরচ যথাক্রমে ৭৬ শতাংশ ও ১২ শতাংশ। সিটি করপোরেশনভুক্ত স্থানে এ হার যথাক্রমে ৮৭ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ। এতে প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যের ওপর নিজ পকেটের ব্যয়ের উচ্চ অংশটি জনসংখ্যার ধনী অংশ দ্বারা চালিত হয়। তিনি জানান, সরকারি ব্যয়ের মধ্যে মোট খরচের ৯৩ শতাংশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় খরচ করে থাকে। অন্যান্য মন্ত্রণালয় এবং সিটি করপোরেশনগুলো সম্মিলিতভাবে বাকি ৭ শতাংশ খরচ করে থাকে। বেসরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে মোট ব্যয়ের ৮৯ ভাগ ব্যক্তিপর্যায়ে নিজ পকেট থেকে খরচ করে। বাকি ১১ শতাংশ বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, এনজিও এবং প্রাইভেট হেলথ ইনস্যুরেন্সের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। ইতোপূর্বে প্রকাশিত বিএনএইচএর তথ্য অনুসারে, ২০১৫ সালে মাথাপিছু স্বাস্থ্য খাতে খরচ ছিল ৩৭ ডলার; যা ২০২০ সালে বেড়ে মাথাপিছু ৫৪ ডলার হয়েছে।
ডা. সুব্রত পাল আরও জানান, বিএনএইচএর তথ্য অনুসারে- ২০১৫ সালে মোট সরকারি স্বাস্থ্য ব্যয়ের মধ্যে সরকারি হাসপাতালগুলোর পেছনে খরচের অনুপাত ৪০ শতাংশ; যা সর্বশেষ প্রকাশিত বিএনএইচআরের তথ্য অনুসারে প্রায় ৪৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় ৫৪ ডলার বা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টাকা (প্রতি ডলার ১০৫ টাকা হিসাবে)। এ ব্যয় শ্রীলংকা ও মালদ্বীপের চেয়েও কম। স্বাস্থ্য খাতে ৩৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের ব্যয় প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে এনজিওগুলোও রয়েছে।
অনেক সময় বরাদ্দ অর্থ ও অন্যান্য লজিস্টিক সাপোর্ট ঠিকঠাক ব্যবহার হয় না জানিয়ে জাহিদ মালেক বলেন, স্বাস্থ্য খাতে এসব ঘাটতি থাকলে দেশ এগোতে পারবে না। এই মুহূর্তে দায়বদ্ধতা ও তদারকি সবচেয়ে বেশি দরকার। দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে অনেক কিছুর পরিবর্তন হবে। পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোর মতো সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে স্বাস্থ্যবিমা চালু করতে হবে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তির পকেট খরচ (স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তি পর্যায়ের খরচ) অনেক বেশি। এ সেবায় সরকার কী পরিমাণ ব্যয় করে সেটিও সামনে আসা উচিত। অনেক লজিস্টিক লাগে, প্রচার-প্রচারণার দরকার হয়। নতুন নতুন অবকাঠামো তৈরি হয়, সেখানেও খরচ হয়। মহামারি আসলে আবার বাড়তি ব্যয় হয়। যেটা ভ্যাকসিনেশনে হয়েছে।
জাহিদ মালেক বলেন, আমরা হয়ত জিডিপির শেয়ার কম পাচ্ছি। এটা বাড়ানো দরকার। পকেট খরচ (স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তি পর্যায়ের খরচ) কমাতে হলে প্রাইভেটের খরচ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আবার বিদেশে বড় একটা অংশ চিকিৎসা নেন, সেটিরও একটা প্রভাব এতে পড়ে। পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় যন্ত্রপাতিসহ অনেক কিছু নষ্ট হয়ে যায়। ফলে চিকিৎসা ব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ জন্য তদারকি ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ওষুধের দাম বাড়াতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তারা চাপে রয়েছেন। মূলত করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ডলার সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে কাঁচামাল আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে। তাই ওষুধের দাম বাড়ানো নিয়ে চাপ রয়েছে। এ জন্য চিকিৎসকদের এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, ‘দেশের ৯৮ শতাংশ ওষুধ আমরা তৈরি করি। দুই শতাংশ ওষুধ আমদানি করা হয়। তাই সমস্যা হওয়ার কথা নয়। চাপ সামাল দিতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। একই সঙ্গে সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন কোম্পানি থেকে চিকিৎসকদের নেওয়া বিভিন্ন উপহার কমিয়ে দিতে হবে।’ বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ওষুধের দাম বাড়ার পেছনে বড় কারণ মার্কেটিং প্রক্রিয়া। চিকিৎসকদের বিভিন্ন উপহার দেওয়া, প্রচারের জন্য মোড়ক চাকচিক্য করাসহ নানা কারণে দাম বেড়ে যায় ওষুধের। তাই মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে কিনা- সেটা খতিয়ে দেখা দরকার।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews