বোমা হামলায় রুশ জেনারেল নিহত হওয়ার ঘটনায় ইউক্রেনকে দায়ী করল রাশিয়া

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: রাশিয়ার সেনাবাহিনীর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে লক্ষ্য করে গাড়ি বোমা হামলা চালানো হয়েছে। মস্কোর পূর্বে বালাশিখা শহরে শুক্রবার এই হামলায় মেজর জেনারেল ইয়ারোস্লাভ মস্কালিক নিহত হয়েছেন। রাশিয়ার তদন্ত কর্মকর্তারা এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
তদন্ত কমিটির বরাত দিয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, মস্কালিক রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের মেইন অপারেশনস ডিরেক্টোরেটের ডেপুটি প্রধান ছিলেন।
এই ঘটনায় একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে কে বা কোন গোষ্ঠী এই হামলার পেছনে রয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
তবে রাশিয়া এ ঘটনায় ইউক্রেনকে দায়ী করেছে। এটি রুশ সামরিক অভিযান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে সাম্প্রতিক সময়ে চালানো একাধিক হত্যাকাণ্ডের সর্বশেষ ঘটনা।
মেজর জেনারেল মস্কালিক রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন। ২০১৫ সালের অক্টোবরে জার্মানি, রাশিয়া, ইউক্রেন ও ফ্রান্সের নর্ম্যান্ডি ফরম্যাট বৈঠকে তিনি রাশিয়ান প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন। ওই বৈঠকের লক্ষ্য ছিল ২০১৪ সালে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধে মিনস্ক চুক্তি বাস্তবায়ন তদারকি করা।
ক্রেমলিনের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ও ক্রেমলিনের সহকারী ইউরি উশাকভের পাশাপাশি মস্কালিক সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফের পক্ষে ওই আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন।
রাশিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রের বরাতে সংবাদমাধ্যম বাজা জানিয়েছে, পার্ক করা একটি গাড়িতে বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দা মস্কালিক সেখানে হেঁটে যাওয়ার সময় দূর থেকে বোমাটি বিস্ফোরণ ঘটায় হামলাকারীরা।
ইজভেস্তিয়া পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, একটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের বাইরে পার্ক করা গাড়ির পাশ দিয়ে এক ব্যক্তি হেঁটে যাচ্ছেন। এরপরই বিস্ফোরণে গাড়ির টুকরো কয়েক মিটার উঁচুতে উঠে যায়।
কমারসেন্ট পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, এই হামলায় আরো একজন নিহত হয়েছেন।
হামলাটি স্থানীয় সময় গতকাল শুক্রবার সংঘটিত হয়। বিস্ফোরণের বিষয়ে এখনো ইউক্রেন কোনো মন্তব্য করেনি। তবে গত তিন বছরে সামরিক কর্মকর্তা এবং ক্রেমলিনপন্থী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর চালানো অন্যান্য হামলার ধাঁচেই এই বিস্ফোরণটি ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডে ইউক্রেনের বিশেষ বাহিনীর সম্পৃক্ততার বিশ্বাসযোগ্য কারণ রয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, যদি ইউক্রেনের সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত হয়, তবে এটি কিয়েভের বর্বরতার পরিচয় হবে এবং যুদ্ধবিরতির আলোচনাকে বানচাল করার জন্য ইউক্রেনের উসকানিমূলক হামলার ইঙ্গিত দিবে।
এই বিস্ফোরণের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনার জন্য মস্কোতে আসছিলেন। ইউক্রেনের দাবি, রাশিয়া শান্তির বিষয়ে আন্তরিক নয়। গত তিন সপ্তাহে রাশিয়ার চালানো একের পর এক মিসাইল হামলায় বহু বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন— কেবল বৃহস্পতিবার কিয়েভে ১২ জন প্রাণ হারান।
রাশিয়ার তদন্ত কমিটি জানায়, মস্কোর পূর্বাঞ্চলের বালাশিখা শহরের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনে একটি ভল্ক্সওয়াগেন গল্ফ গাড়িতে বিস্ফোরণের ঘটনায় হত্যার মামলা দায়ের করা হয়েছে। এএফপির সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে একটি লাশ কালো প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে দেখেছেন। শুক্রবার পুলিশ ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছিল এবং আশেপাশে অ্যাম্বুলেন্স ও দমকল বাহিনীর গাড়ি অবস্থান করছিল।
বিস্ফোরক ডিভাইস
রাশিয়ার তদন্ত কমিটির প্রকাশিত ফুটেজে দেখা যায়, সাদা রঙের একটি গাড়ি বিস্ফোরণে পুড়ে গেছে এবং সামনের অংশ সম্পূর্ণভাবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সকাল ১০টা ৪৫ মিনিট নাগাদ তারা বিকট শব্দ শুনতে পান।
সেখানকার বাসিন্দা লিউদমিলা এএফপিকে বলেন, ‘বিস্ফোরণ এতটাই প্রবল ছিল যে আমার বুকে ব্যথা শুরু হয়ে যায়।’ এই হত্যাকাণ্ড রাশিয়ার তিন বছরব্যাপী ইউক্রেন আগ্রাসনে জড়িত বিভিন্ন ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে কিয়েভের দাবি করা আগের হামলাগুলোর মতোই বলে মনে হচ্ছে।
গত ডিসেম্বরে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, তারা রাশিয়ার সেনাবাহিনীর রাসায়নিক অস্ত্র শাখার প্রধান জেনারেল ইগর কিরিলভকে হত্যা করেছে। কিরিলভের বাসার বাইরে একটি স্কুটারে বসানো দূরনিয়ন্ত্রিত বোমা বিস্ফোরণে তিনি নিহত হন।
তদন্তকারীরা জানান, হামলাকারীরা ধাতব টুকরো দিয়ে ভর্তি একটি বিস্ফোরক ডিভাইস ব্যবহার করেছে, যা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সাধনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। যা তারা নিজেরাই তৈরি করেছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা টাস জানায়, নিহত মস্কালিকের বয়স ছিল ৫৯ বছর।
গুরুতর ব্যর্থতা
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২০২১ সালে মস্কালিককে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদ দেন। মস্কালিকট ছিলেন ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনার মূল সংযোগস্থল। গত তিন বছরে ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান সংক্রান্ত ব্যক্তিদের একাধিক হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে দেখা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০২২ সালের আগস্টে জাতীয়তাবাদী দারিয়া দুগিনার গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু এবং ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সেন্ট পিটার্সবার্গের এক ক্যাফেতে বিস্ফোরণে সামরিক ব্লগার ম্যাক্সিম ফোমিন ওরফে ভ্লাদলেন তাতারস্কির নিহত হওয়া।
কয়েকটি ঘটনার দায় স্বীকার করেছে কিয়েভ, আবার কিছু ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করে বলেছে, ‘এসব ব্যক্তি বৈধ লক্ষ্য, কারণ রাশিয়ার চলমান আগ্রাসনে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।’
কিরিলভ হত্যার পর রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন শক্তিশালী নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার জন্য প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন, যা বিরল। তিনি বলেন, ‘এমন গুরুতর ভুলগুলো আর ঘটতে দেওয়া যাবে না।’