যশোর গণহত্যা দিবস আজ, ৫২ বছরেও মেলেনি শহীদদের স্বীকৃতি

প্রথম নিউজ, যশোর : ৪ এপ্রিল যশোরের গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এইদিনে যশোরে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা শহরজুড়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন যশোরের রাজনীতিক, শিক্ষক, ছাত্র, পেশাজীবী ও ধর্মীয় নেতারা। সেদিনের গণহত্যায় ৫১ জন নিহতের কথা বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা আরও কয়েক গুণ বেশি ছিল।
তবে স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও সেদিনের শহীদদের স্বীকৃতি মেলেনি। নেই কোনো স্মৃতিস্মারকও। ওইদিনের শহীদদের স্বীকৃতির দাবিতে বছরের পর বছর ঘুরছেন স্বজনরা। কিন্তু কোনো সাড়া মিলছে না।
তথ্য মতে, সারাদেশের মতো যশোরেও ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধপ্রস্তুতি। আর এপ্রিলের শুরু থেকেই গোটা বাঙালি জাতি পুরোদমে যুদ্ধজয়ের প্রস্তুতিতে মাঠে নেমে পড়ে। এই যুদ্ধপ্রস্তুতিকে থামিয়ে দিতে নৃশংস হয়ে ওঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। এসময় যশোর ক্যান্টনমেন্টের পাকিস্তানি সেনারা শহরের বিভিন্ন স্থানে চালাতে থাকে বর্বরোচিত হামলা। যশোরে তাদের সবচেয়ে নৃশংসতম হামলার অনেকগুলোই ঘটে ৪ এপ্রিল।
ওইদিন হানাদার বাহিনী শহরের বিভিন্ন বাড়িতে ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে তাণ্ডব চালায়। প্রকাশ্যে গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে তারা হত্যা করে অর্ধশতাধিক বাঙালিকে। সবচেয়ে বড় ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটে যশোর রেলস্টেশন মাদরাসা প্রাঙ্গণে।
সেদিনের সেই নারকীয় তাণ্ডবের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী রেলস্টেশন এলাকার বাসিন্দা শেখ আব্দুর রহিম বলেন, ৪ এপ্রিল ভোরে শহরের রেলস্টেশন মাদরাসার শিক্ষার্থীরা ফজরের নামাজ শেষ করে কোরআন শরীফ পাঠ করছিল। এমন সময় স্থানীয় বিহারিদের সহায়তায় হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মাদরাসা প্রাঙ্গণে তাণ্ডব শুরু করে। এসময় মাদরাসার বড় হুজুর আবুল হাসান তাদের নিবৃত করতে যায়। তখন বিহারিরা আর্মিদের বলে, ‘এরা সবাই ইপিআর; পাকিস্তানের শত্রু।’ এরপরই পাকিস্তানি আর্মি নির্বিচারে গুলি চালায়।
তিনি বলেন, মাদরাসা প্রাচীরের পাশ থেকে এই দৃশ্য দেখে পালিয়ে যাই। পরে দুপুরের দিকে বড় ভাই জাহাঙ্গীরসহ মাদরাসা প্রাঙ্গণে এসে দেখি গোটা এলাকায় শুধু লাশ আর লাশ। এখানেই পাওয়ায় ২৩ জনের মরদেহ। তাদের মধ্যে ১৬ জনের পরিচয় পাওয়া গেলেও বাকি সাতজনের পরিচয় আজও জানা যায়নি।
মাদরাসা প্রাঙ্গণে আত্মরক্ষার জন্য খোঁড়া গর্তে রহিম ও জাহাঙ্গীর মরদেহগুলো একের পর এক সাজিয়ে মাটিচাপা দেন। সেদিনের নৃশংস ঘটনাটি বর্তমানে মাদরাসা ট্র্যাজেডি নামে পরিচিত। এখানে নিহতদের যে ১৬ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে, তারা হলেন একই পরিবারের তাহের উদ্দিন, এ বি এম আব্দুল হামিদ ও এ বি এম কামরুজ্জামান এবং একই এলাকার কাজী আব্দুল গণি ও তার ছেলে কাজী কামরুজ্জামান। একই পরিবারের তিন সদস্য তৎকালীন খুলনা কমিশনার অফিসের কর্মচারী দীন মোহাম্মদ, সম্মিলনী স্কুলের শিক্ষক আইয়ুব হোসেন ও কাজী আব্দুল কালাম আজাদ, রেলস্টেশন মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা হাবিবুর রহমান ওরফে কাঠি হুজুর, শহীদ সাংবাদিক গোলাম মাজেদের বাবা যশোর জিলা স্কুলের শিক্ষক আব্দুর রউফ, শহর আলীর ছেলে আবু কালাম এবং মাদরাসার ছাত্র আতিয়ার রহমান, নোয়াব আলী, লিয়াকত আলী, মাস্টার আব্দুর রফিক ও আক্তার হোসেন।
একইদিনে শহরের গুরুদাসবাবু লেনেও চলে হানাদারদের নারকীয় তাণ্ডব। এই লেনের বাড়ি থেকে অ্যাডভোকেট সৈয়দ আমীর আলী ও তার তিন ছেলে এম এম কলেজের ছাত্র সৈয়দ নুরুল ইসলাম বকুল, সৈয়দ শফিকুর রহমান জাহাঙ্গীর এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থী আজিজুল হককে সেনারা ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে নির্মম নির্যাতনের পর তাদের হত্যা করা হয়।
ওইদিনেই সেনারা শহরের ক্যাথলিক গির্জায়ও আক্রমণ করে। সেখানে গির্জার ইতালিয়ান ফাদার মারলো ভারনেসিসহ ছয়জনকে হত্যা করা হয়। এছাড়া সেদিন শহরের বিভিন্ন স্থানে হানাদার ও তাদের দোসরদের হাতে শহীদ হন তৎকালীন যশোর শহর ছাত্রলীগের সভাপতি এম এম কলেজের ছাত্র মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, এম এম কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মোছাদ্দেদ আলী, ছাত্রলীগ নেতা ওমর ফারুক, নিখিল রায়, নাসিরুল আজিজ, অধ্যক্ষ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, আওয়ামী লীগ নেতা রহমত আলী, তৎকালীন অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট রহমতউল্লাহ, ইপিআর সদস্য আব্দুল মান্নান, ক্রিকেটার স্বপন বিশ্বাস, ডা. নাসির উদ্দিন ও মিসেস নাসির, আব্দুর রহমান, লুৎফর রহমান, মিসেস জাবেদা লুৎফর, চিত্রশিল্পী আমিনুল ইসলাম, আব্দুল লতিফ, মাহবুব এবং ভোলাট্যাংক রোডের অবসরপ্রাপ্ত সেরেস্তাদার আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী।
এ প্রসঙ্গে শহীদ অ্যাডভোকেট সৈয়দ আমীর আলীর ছেলে সাংবাদিক সৈয়দ শাহাবুদ্দিন আলম বলেন, আমার বাবা ও তিন ভাইকে সেদিন নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ও যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির নাম ফলকে শহীদ আইনজীবীর তালিকায় আমার বাবার নাম রয়েছে। তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবী। কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘শহীদ’ স্বীকৃতি মেলেনি। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। আবেদনটি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিলে (জামুকা) পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়। কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই। যতদিন স্বীকৃতি না পাবো দাবি জানিয়ে যাবো।
শুধু সৈয়দ শাহাবুদ্দিন আলম নন, তার মতো শহীদ পরিবারের সন্তান ও স্বজনরা তাদের স্বজনের শহীদ স্বীকৃতির দাবিতে বছরের পর বছর অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছরেও মেলেনি সেই স্বীকৃতি। তাদের দাবি, অবিলম্বে শহীদদের স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
এ প্রসঙ্গে যশোর সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আফজাল হোসেন দোদুল বলেন, গণহত্যায় শহীদদের কবর সংরক্ষণে সরকারের প্রকল্প চলমান। পর্যায়ক্রমে সব গণকবর চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করবে সরকার। গণহত্যার শিকার শহীদদের স্বীকৃতির দাবি দীর্ঘদিনের। এছাড়া যশোরের গণহত্যা দিবসের কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মারক নেই।
তিনি কবর সংরক্ষণ, শহীদদের স্বীকৃতি ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানান।
নোংরামো রয়েছে যা তারা ম্যানেজ করতে পারে না। এ কারণে অন্য লোকদের ধমক দিতে শুরু করে।’