ইশরাকের শপথ কবে, মেয়রের মেয়াদ হবে কতদিন

প্রথম নিউজ, অনলাইন: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র পদে বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়িয়ে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে নগর ভবনে তালা ঝুলিয়ে লাগাতার আন্দোলনে বিএনপির নেতাকর্মীরা। ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায় এবং ইসির গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে মামুনুর রশিদ নামে সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী গত ১৩ মে রিট করেন। গত মঙ্গলবার রিটের ওপর শুনানি নিয়ে আদেশের জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার দিন রাখেন হাইকোর্ট।
এর ঠিক একদিন আগে গত বুধবার সকাল থেকে ইশরাককে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে রাজধানীর কাকরাইল ও মৎস্য ভবনসহ সুপ্রিম কোর্টের আশপাশের এলাকায় আন্দোলন শুরু করে বিএনপি ও ইশরাকের কর্মী-সমর্থকরা।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কর্মসূচি স্থগিত করে রাজপথ থেকে ঘরে ফেরেন তারা। তবে, এর আগে ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ঘোষণা করে ইসি দেওয়া গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে করা রিট সরাসরি খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। আদালতের এ আদেশের পর আন্দোলনকারীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে স্লোগান দেন।
ইশরাক হোসেনকে যদি মেয়র পদ বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তিনি আগামী ২৯ জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। অর্থাৎ সপ্তাহ পাঁচেকের জন্য মেয়র হবেন তিনি। তবে শপথ নিতে যত দেরি হবে, এই পাঁচ সপ্তাহ সময় তত কমে আসবে
ইশরাকের শপথসহ সার্বিক বিষয়টি নিয়ে এখন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে জানা গেছে। ইশরাক নিজেও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মেয়র পদ নিয়ে নানা জটিলতার পর এখন শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলে মেয়র হিসেবে তিনি কতদিন দায়িত্ব পালন করতে পারবেন সে প্রশ্ন উঠেছে। তার আগে অবশ্য দেখার পালা কবে শপথ নিচ্ছে ইশরাক।
আইনজীবীদের কেউ কেউ বলছেন, দক্ষিণ সিটির নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা ও ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়ে পরবর্তী মেয়রকে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত ইশরাক হোসেন দায়িত্ব পালন করবেন। আইনজীবীদের একজন জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, পূর্ণ মেয়াদে (৫ বছর) তাকে দায়িত্ব পালন করা উচিত। অন্য একজন আইনজীবী মনে করছেন, ইশরাকের এখন মেয়র পদে বসা উচিত হবে নাকি পরবর্তী সিটি নির্বাচনের দাবি তোলা উচিত হবে সেটি তার ভাবা দরকার। আগামীতে দক্ষিণ সিটির মেয়র হলে জনগণের জন্য করণীয় কী হবে, ইশরাকের এখন সে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন।
নির্বাচন কমিশন শুধু গেজেট করেন। এটি নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলছেন, এটি সঠিক নয়। ইলেকশন কমিশনের এখানে কন্টেস্ট করার সুযোগ নেই। গেজেট হয়েছে, গেজেটের ত্রিশ দিনের মধ্যে শপথ দিতে হবে। এটি হলো আইনি বাধ্যবাধকতা। এসময়ের মধ্যে শপথ না দিলে আদালত অবমাননা হবে।- ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ঢাকার দুই সিটিসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশেনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এসব জায়গায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে প্রশাসক। তবে নির্বাচনের পর করা মামলার রায়ে গত ১ অক্টোবর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে শাহাদাত হোসেনকে, গত ২৭ মার্চ ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করে আদালত। অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাকের নামে গেজেটও জারি হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, এর মধ্যেই নির্বাচন ও আগের মেয়রের শপথগ্রহণের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। তবে সিটি করপোরেশনের প্রথম বোর্ড সভার পাঁচ বছর পূর্ণ হতে এখনো পাঁচ সপ্তাহের মতো বাকি। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯-এর ৬ ধারায় বলা হয়েছে, করপোরেশনের মেয়াদ প্রথম সভার তারিখ থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটির সবশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র হন। ওই বছরের ১৬ মে দায়িত্ব নেওয়ার পর ৩০ জুন প্রথম বোর্ড সভা হয়। সে মোতাবেক করপোরেশনের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী ২৯ জুন।
এর মধ্যেই যদি ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদ বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তিনি আগামী ২৯ জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। অর্থাৎ সপ্তাহ পাঁচেকের জন্য মেয়র হবেন তিনি। তবে শপথ নিতে যত দেরি হবে, এই পাঁচ সপ্তাহ সময় তত কমে আসবে।
গেজেট করার ক্ষেত্রেও আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নেওয়া হয়নি। বিএনপির চাপেও গেজেট করা হতে পারে। ইশরাক হোসেন একজন ভদ্রলোক। আশা করি, এসব প্রচেষ্টা বন্ধ করে সরকারকে ইমিডিয়েটলি সিটি নির্বাচন দিতে চাপ দেবেন।- আইনজীবী মোহাম্মদ মহসীন রশীদ
ইশরাক হোসেনের ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, আদালতের রায় যেহেতু পক্ষে এসেছে, পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন গেজেটও প্রকাশ করেছে তাই সময় যে কয়দিন হাতে থাকুক মেয়র হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করতে চান। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে শপথ অনুষ্ঠানসহ সার্বিক পরিস্থিতির দিকেও তার লোকজন নজর রাখছেন।
সিটি করপোরেশন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পরিষদ বিলুপ্ত করে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রয়েছে স্থানীয় সরকার আইনে। আদালতের ভিন্ন কোনো আদেশ না থাকলে ২৯ জুনের পর দক্ষিণ সিটির জন্যও অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে। এর আগে একইভাবে গত বছরের ১ অক্টোবর চট্টগ্রাম সিটির নির্বাচনে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন চৌধুরীকে মেয়র ঘোষণা করা হয়েছিল। তিনি এখন চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইন অনুযায়ী শপথ পড়ানো গেলে মন্ত্রণালয় এতে বাধা দেবে না। ইশরাক মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নিলে কতদিন কোন আইনে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবেন- সেই প্রশ্নে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা এর আগে বলেছেন, বাকি মেয়াদের জন্য নাকি নতুন যোগ দেওয়ার পর থেকে মেয়াদ শুরু হবে- সেটি ইসির গেজেট প্রকাশ, আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত ও স্থানীয় সরকার বিভাগের পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন জাগো নিউজকে বলেছেন, কোর্ট গেজেট করার জন্য ইলেকশন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন। কমিশন রায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী গেজেট করেছেন। আপনারা নিশ্চয় নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য দেখেছেন। স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন কখনো কোনো নির্বাচন নিয়ে আদালতে কন্টেস্ট করেনি। প্রার্থীদের প্রতিনিধিরা কন্টেস্ট করেছেন।
‘নির্বাচন কমিশন শুধু গেজেট করেন। এটি নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলছেন, এটি সঠিক নয়। ইলেকশন কমিশনের এখানে কন্টেস্ট করার সুযোগ নেই। গেজেট হয়েছে, গেজেটের ত্রিশ দিনের মধ্যে শপথ দিতে হবে। এটি হলো আইনি বাধ্যবাধকতা। এসময়ের মধ্যে শপথ না দিলে আদালত অবমাননা হবে।’
শপথের পর কতদিন দায়িত্ব পালন করবেন- জানতে চাইলে ব্যারিস্টার খোকন বলেন, শপথগ্রহণের পর দায়িত্ব নিলে পরবর্তী নির্বাচিত মেয়র না আসার আগ পর্যন্ত ইশরাক হোসেন মেয়রের দায়িত্ব পালন করবেন। স্থানীয় সরকারের আইন অনুযায়ী, এটি হলো উনার দায়িত্ব পালনের সময়সূচি।
তিনি বলেন, সংবিধানের ৫৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে। এখানে প্রশাসকের কোনো সুযোগ নেই। কারণ, প্রশাসকের কোনো জবাবদিহি নেই’।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ মহসীন রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। কাজেই মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে এখন কোনো ধরনের শপথ হবে না। শপথ টোটালি ইলিগ্যাল। এখন যেটা করা উচিত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির নির্বাচনের জন্য তফসিল (সিডিউল) ঘোষণা করা। অন্যথায় টোটালি বেআইনি হবে।
‘এমনকি গেজেট করার ক্ষেত্রেও আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নেওয়া হয়নি। এছাড়া বিএনপির চাপেও গেজেট করা হতে পারে। ইশরাক হোসেন একজন ভদ্রলোক। আশা করি, এসব প্রচেষ্টা বন্ধ করে সরকারকে ইমিডিয়েটলি সিটি নির্বাচন দিতে চাপ দেবেন তিনি।’
সুপ্রিম কোর্টের আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার জাগো নিউজকে বলেন, এটা তো উপনির্বাচন না। উপনির্বাচন হলে মেয়াদের বাকি সময়টা মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। আদালত যদি ভিন্ন কোনো আদেশ না দেন তাহলে যে মেয়াদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সে মেয়াদ পর্যন্ত ইশরাক হোসেন দায়িত্ব পালন করতে পারবেন বলে আমার ধারণা।
‘আর আদালত যদি প্যাসিফিক কোনো আদেশ না দিয়ে থাকেন তাহলে সেই সুযোগ ইশরাক হোসেনকে পূর্ণ মেয়াদে দেওয়া উচিত। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আইন এখানে প্রযোজ্য হবে যদি সর্বোচ্চ আদালত কোনো নির্দেশনা না দিয়ে থাকেন’- বলেন অ্যাডভোকেট তৈমুর।
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র পদে নির্বাচিত হন। নির্বাচন কমিশন ২ ফেব্রুয়ারি ভোটের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করে। এরপর শপথ নিয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন ব্যারিস্টার তাপস।
সেই নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদে তাপস পেয়েছিলেন সোয়া চার লাখ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী ইশরাক পান দুই লাখ ৩৬ হাজার ভোট। নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফল বাতিল চেয়ে ২০২০ সালের ৩ মার্চ মামলা করেন ইশরাক।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের সব সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন অতিরিক্ত সচিব শাহজাহান মিয়া।
এর মধ্যে গত ২৭ মার্চ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ফজলে নূর তাপসকে বিজয়ী ঘোষণার ফল বাতিল করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম। আদালত ১০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেন।
রায় পাওয়ার পর গত ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। এরপর মেয়র হিসেবে ইশরাকের শপথের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় কমিশন। কিন্তু মন্ত্রণালয় শপথ অনুষ্ঠানের কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় নগর ভবনে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন ইশরাকের সমর্থকেরা। নগর ভবনে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করা হয় স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়াকে।