ঈদের তাৎপর্য

ঈদের তাৎপর্য

প্রথম নিউজ ডেস্ক: ঈদ ‘আউদুন’ মূল ধাতু থেকে নির্গত আরবি শব্দ। এর অর্থ বারবার ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা। প্রতি বছরই নিয়মিতভাবে দু’বার করে এর আগমন ঘটে; তাই একে ঈদ বলে নামকরণ করা হয়েছে। অতএব ঈদ অর্থ ফিরে আসার আনন্দ। কেউ কেউ বলেছেন, এ দিনে আল্লাহ তায়ালা বান্দার প্রতি রহমতের দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন বলে এ দিনকে ঈদের দিন বলা হয়। রমজানের কঠোর সাধনা, ইবাদত-বন্দেগি ও সিয়ামের প্রতিদানস্বরূপ মহা পুরস্কার ঘোষণার দিন হচ্ছে ঈদের দিন। শাওয়াল মাসের পয়লা তারিখ হলো এ আনন্দের ও পুরস্কারপ্রাপ্তির দিন। ফিতর অর্থ ভঙ্গ করা। সুতরাং ঈদুল ফিতর অর্থ রোজা ভঙ্গ করার আনন্দ।
মু’মিনের আনন্দ-উৎসব, শোক-তাপ, সুখ-দুঃখ, জীবন-মরণ এক কথায় সবই তার রবের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘হে রাসূল! আপনি বলুন! আমার সালাত, আমার বন্দেগি, আমার জীবন, আমার মরণ সবই আল্লাহর জন্য।’(সূরা আল আনআম-১৬২) সুতরাং অন্যান্য জাতি বা অমুসলিমরা উৎসবের দিনে যা কিছু করে মু’মিন তা করতে পারে না। অন্যান্য জাতির আনন্দ-উৎসব হচ্ছে এই ক্ষণস্থায়ী জগতের সুখ-সম্ভোগ অর্জন এবং ইন্দ্রিয়জ কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা। পক্ষান্তরে মু’মিনের কামনা-বাসনা, ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা, চাওয়া-পাওয়া ইত্যাদি তার মালিকের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। তার আনন্দ-উৎসব ও আকাক্সক্ষা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির অধীন। মু’মিনের বড় উৎসব হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার আনুগত্যে মাথানত করায় এবং তার প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনায়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আমার নিদর্শনাবলির প্রতি তারাই ঈমান আনে, যাদেরকে যখন তাদের সেই নিদর্শনাবলির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়, তখন তারা সিজদায় গমন করে এবং তাদের প্রতিপালকের প্রশংসায় তাসবিহ পাঠ করে। আর তারা কখনো দম্ভ প্রকাশ করে না; (এমনকি) রাত্রে শয়ন করলেও তাদের বাহু বিছানার সাথে মেশে না। (বরং তারা আল্লাহর রহমতের) আশায় আশান্বিত এবং তাঁর (শাস্তির) ভয়ে ভীত-শঙ্কিত অন্তর নিয়ে পার্শ্ব পরিবর্তনকালে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকে।’ (সূরা আস-সিজদা-১৫)
ঈদের সূচনা : হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, মহানবী সা: যখন মদিনায় গমন করেন, তখন তিনি দেখতে পান মদিনাবাসী, যাদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক লোক আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তারাও দু’টি জাতীয় উৎসব পালন করছে। আর এতে তারা খেল-তামাশার আনন্দ উৎসব করছে। মহানবী সা: তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা যে এ দু’দিন উৎসব পালন করো, এর তাৎপর্য কী? তারা প্রত্যুত্তরে বলল, ইসলামপূর্ব জাহেলিয়াতের যুগে আমরা এ উৎসব এমনি হাসি-খেলা ও আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমেই উদযাপন করতাম, এখন পর্যন্ত তাই চলে আসছে। মহানবী সা: তাদের কথা শুনে বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের এ দু’টি উৎসবের পরিবর্তে তদপেক্ষা অধিক উত্তম দু’টি দিন দান করেছেন। তা হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। অতএব এখন থেকে আগের উৎসব বন্ধ করে এ দু’টি দিনের নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানাদি পালন করতে শুরু করো।’ (নাসায়ি-১৫৫৬, আবু দাউদ-১১৩৪)
আমাদের ঈদের স্বাতন্ত্র্য : আমাদের ঈদ উৎসব সম্পূর্ণ অশ্লীলতামুক্ত। এতে নেই গান-বাজনা, হইহুল্লোড়, পটকাবাজি, আতশবাজি, রঙ নিক্ষেপ ইত্যাদি। আমাদের উৎসবে নেই ধনী-গরিবের ভেদাভেদ। আমাদের ঈদ উৎসব শরিয়তের আদেশ-নিষেধের মধ্যে সীমিত। শরিয়ত সমর্থন করে না এমন কাজ করা হয় না। ধনী-গরিবের ব্যবধান দূর করার নিমিত্তে রয়েছে ঈদুল ফিতরে ফিতরার ব্যবস্থা। আর ঈদুল আজহায় কোরবানির গোশত দান করার বিধান। মু’মিনের ঈদের উদ্দেশ্য কেবল আনন্দ উপভোগ করা নয়; বরং নিজের সুখ অপরকে বিলি করা, অন্যের দুঃখে দুঃখী হওয়া, ধনী-গরিবের বৈষম্য ভুলে গিয়ে সবাই এককাতারে শামিল হওয়া ঈদের মূল উদ্দেশ্য।

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের নির্দিষ্ট দিবসগুলোর পরে এ ঈদ আসার তাৎপর্য হলো, আমরা যেন পবিত্র হয়ে এ ঈদ উদযাপন করি। কারণ রোজা আমাদের থেকে পাপ পঙ্কিলতা, কলুষতা, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, ক্রোধ, কুটিলতা, পরশ্রীকাতরতা, সঙ্কীর্ণতা ইত্যাদি নির্মূল করে দিয়েছে। আর আমাদের মধ্যে আনয়ন করেছে উদারতা, নম্রতা, ভদ্রতা, ক্ষমা, মহত্ত্ব, মানবতাবোধ, প্রেম-ভালোবাসা, সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা, দানশীলতা, ধৈর্য, কষ্টসহিষ্ণুতা, মনের প্রশস্ততা, আচার-আচরণের মাধুর্যতা ইত্যাদি।
ঈদে করণীয় : ঈদের দিনকে কেবল আনন্দের দিন মনে না করে ধর্মীয় আদেশ-নিষেধের প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। ফলে ঈদের করণীয় কাজ হলো-
ইবাদতের দিবস মনে করা : মু’মিনের ঈদ শুধু আনন্দ উৎসবের দিবস নয়, বরং একটি ইবাদতের দিবস। এ দিবস আমাদের জন্য একটি বিরাট নিয়ামত। এ দিনেও রয়েছে কিছু বিশেষ আমল বা ইবাদত। মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পাঁচটি রাত জেগে ইবাদত করবে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হবে। রাতগুলো হলো- জিলহজের রাত, আরাফার রাত, ঈদুল আজহার রাত, ঈদুল ফিতরের রাত এবং শাবানের রাত। সুতরাং ঈদুল ফিতরের রাতে ইবাদত করা খুবই পুণ্যময় কাজ এবং এ ব্যাপারে মু’মিন বান্দাদের একান্তভাবে সতর্ক থাকা আবশ্যক। অন্য দিনের চেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা এ দিনের বিশেষ সুন্নাত। তারপর মিসওয়াকসহ অজুু করে ফজরের সালাত আদায় করবে।
ঈদুল ফিতরের সুন্নাত : ঈদুল ফিতরের সুন্নাত কাজগুলো হলো- ১. প্রত্যুষে ঘুম থেকে উঠে গোসল করা; ২. মিসওয়াক করা; ৩. সুগন্ধি ব্যবহার করা; ৪. চোখে সুরমা ব্যবহার করা; ৫. পবিত্র পরিচ্ছন্ন উত্তম পোশাক পরিধান করা; ৬. যথাশিগগিরই ঈদগাহে যাওয়া; ৭. মিষ্ট দ্রব্য খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া; ৮. ঈদগাহে যাওয়ার আগে সাদাকায়ে ফিতর আদায় করা; ৯. ঈদগাহে এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া অন্য রাস্তা দিয়ে আসা এবং যথাসম্ভব হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া; ১১. অসুবিধা না হলে মাঠে ঈদের সালাত পড়া, ১২. ঈদগাহে আসা-যাওয়ার পথে নিম্নস্বরে তাকবিরে তাশরিক পড়া।

ঈদের সালাত : ঈদের মূল আনুষ্ঠানিকতা হলো ঈদগাহে গিয়ে সালাত আদায় করা। পূর্ণ এক মাস আল্লাহর হুকুমে তারই সন্তুষ্টি লাভের আশায় মাঠে গিয়ে সালাত আদায় করা। ঈদ একটি বার্ষিক সম্মেলন। সব মু’মিন হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সালাতে দাঁড়িয়ে যায়। ঈদের জামাতে একে অন্যের সাথে সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময়ের একটি অপূর্ব সুযোগ। ছোট-বড়, ধনী-গরিব, আমির-ফকির, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। ছয় তাকবিরের সাথে দু’রাকাত সালাত আদায় করা ওয়াজিব। এ সালাত আদায়ের সময় সূর্যোদয়ের পর থেকে দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত। কেউ ঈদের দিন ঈদের সালাত পড়তে না পারলে পরে কাজা করার কোনো সুযোগ নেই।
পবিত্র ঈদের দিনের রয়েছে অনেক ফজিলত। ঈদের দিনে মুসল্লি আল্লাহর মেহমান। আল্লাহ তায়ালা তার মেহমানকে অফুরন্ত পুরস্কার দানে ধন্য করেন। মহানবী সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি পুণ্য লাভের অদম্য স্পৃহায় দুই ঈদের রাতে জেগে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকবে, সে দিন তার অন্তর এতটুকু ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে না, যে দিন অন্য সবার অন্তর ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে।’ মহানবী সা: আরো বলেন, ‘যারা ঈদের সালাত আদায় করার জন্য ঈদগাহে একত্রিত হয় আল্লাহ তায়ালা তাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের জিজ্ঞেস করেন, যারা স্বেচ্ছায় দায়িত্ব পালন করে আজ ঈদগাহে সমবেত হয়েছে তাদের কী প্রতিদান দেয়া উচিত? ফেরেশতারা প্রত্যুত্তরে বলেন, তাদের পুণ্যময় কাজের সম্পূর্ণ পারিশ্রমিক দেয়া উচিত। তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর মর্যাদার শপথ করে বলেন, তিনি অবশ্যই তাদের প্রার্থনা কবুল করবেন। অতঃপর তিনি ঈদগাহে মুসল্লিদের উদ্দেশে ঘোষণা দেন, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। আর তোমাদের কৃত অতীত পাপকে নেকিতে পরিণত করে দিয়েছি। এ প্রসঙ্গে মহানবী সা: বলেন, ‘সালাত সমাপনকারীরা নিষ্পাপ অবস্থায় ঈদের মাঠ থেকে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করে, যেন তারা নবজাতক নিষ্পাপ শিশু।’
ঈদ আসে বার্ষিক আনন্দের বার্তা নিয়ে, সীমাহীন প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও কল্যাণের সওগাত নিয়ে। ফলে সেই ঈদকে যথার্থ মর্যাদার সাথে উদযাপন করা এবং যথাযথভাবে ঈদের সালাত আদায় করা প্রত্যেক ঈমানদারের কর্তব্য। বছরে দু’দিন যে সম্মেলনের ব্যবস্থা দয়াময় আল্লাহ তায়ালা করে দিয়েছেন, এর মাধ্যমেই মানুষ গড়তে পারে কুরআনে নির্দেশিত সুন্দর ও সুশৃঙ্খল সমাজ এবং ইসলামী শাসনব্যবস্থা। যার ফলে সমাজ থেকে দূর হবে সব অন্যায়, অবিচার, হিংসা-বিদ্বেষ ও সর্বপ্রকারের পাপাচার।
সূত্র দৈনিক নয়াদিগন্ত। লেখক :মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।