না’গঞ্জে ওসমান পরিবারের ডন হিসেবে খ্যাত আজমেরী একসঙ্গে দুটি অস্ত্রের লাইসেন্স চাইলেন
তার বিরুদ্ধে গুম, খুন, চাঁদাবাজিসহ বিশাল সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে।

প্রথম নিউজ, নারায়ণগঞ্জ : একসঙ্গে দুটি অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদন করেছেন নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের ডন হিসেবে খ্যাত ও প্রয়াত এমপি ও জাপা সাবেক নেতা নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমান। সে বর্তমানে তার বাহিনীর প্রধান হিসেবে তাকে ’হাজীসাব’ নামে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে গুম, খুন, চাঁদাবাজিসহ বিশাল সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। তাই আজমেরী ওসমানের অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নারায়ণগঞ্জের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা। তারা বলছেন, সন্ত্রাসী বা রাজনৈতিক পরিচয়ের কোন ব্যক্তিকে অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে তার অপব্যবহার হবে কিনা এর যাচাই বাচাই করা উচিৎ।
জানা গেছে, একটি বন্দুক ও একটি পিস্তলের লাইসেন্সের জন্য আজমেরী ওসমান গত এপ্রিল মাসে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে লিখিত আবেদন করেছেন। পরে তার আবেদনটি তদন্তের জন্য জেলা পুলিশ সুপারের বিশেষ শাখায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে সেটি তদন্তের জন্য পাঠানো হয় ফতুল্লা থানা পুলিশের কাছে। তদন্ত শেষে গত সোমবার (১৫ মে) ক-সার্কেল অফিসে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করলেও বিষয়টি স্বীকার করছেন না ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রিজাউল হক খান। তবে আজমেরী ওসমানের দুটি অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদনের তদন্তভার পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রিজাউল হক সময় বলেন, ‘এটা আমাদের ডিপার্টমেন্টের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না। যেটা সঠিক, সে অনুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদন হবে।’
জানতে চাইলে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক-সার্কেল) নাজমুল হাসান সময় বলেন, ‘প্রতিবেদন এসেছে কিনা আমি জানি না। খবর নিতে হবে। হয়তো এসে থাকতে পারে।’ এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, আজমেরী ওসমানের অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদনটি তদন্তের জন্য থানা পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে। থানা পুলিশ এখনও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত ও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর
মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার ঘটনায় ওই বছরের ১২ নভেম্বর আজমেরী ওসমানের সহযোগী সুলতান শওকত ভ্রমর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে স্বীকারোক্তি দেন যে, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ত্বকীকে অপহরণের পর তার টর্চার সেলে এগারোজন মিলে হত্যা করেছে।
পরে আজমেরী ওসমানের গাড়িতে করেই ত্বকীর লাশ শীতলক্ষ্যা নদীর একটি শাখা খালে ফেলে দেয়া হয়। ত্বকী হত্যা মামলার তদন্তকারী সংস্থা র্যাব-১১ হত্যাকাণ্ডের এক বছর পর ২০১৪ সালের ৫ মার্চ খুনিদের শনাক্ত, হত্যার রহস্য উদঘাটন ও অভিযোগপত্র প্রস্তুতের বিষয়টি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে। র্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান এ ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ১১ জন মিলে ত্বকীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলাটির অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হবে। কিন্তু দীর্ঘ ৯ বছর অতিবাহিত হলেও, এখন পর্যন্ত অভিযোগপত্র দাখিল করেনি তদন্তকারী সংস্থা র্যাব-১১।
ত্বকী হত্যাকাণ্ড ছাড়াও আজমেরী ওসমান ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, গুম, খুন ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। তার নিয়ন্ত্রিত হোন্ডা বাহিনী (মোটরসাইকেল বাহিনী) শহর দাপিয়ে বেড়ায়। এছাড়া জমি দখল, অস্ত্র প্রদর্শন করে ভয়ভীতি দেখানো ও বিভিন্ন পোশাক কারখানায় চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে আজমেরী ওসমানের এই বাহিনীর বিরুদ্ধে। ত্বকী হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় ২০২২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি শহরের প্রেসিডেন্ট রোড এলাকায় ‘সময়ের নারায়ণগঞ্জ’ নামে স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা অফিসে মোটরসাইকেল বহর নিয়ে হামলা হয়।
ওই ঘটনায় পত্রিকার সম্পাদক জাবেদ আহমেদ আজমেরী ওসমানের ১৯ সহযোগীসহ ৫৯ জনের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা করেন। সবশেষ গত ১৬ মার্চ আজমেরী ওসমানের অর্ধশতাধিক ক্যাডার মোটরসাইকেল ও গাড়ির বহর নিয়ে বন্দর উপজেলার ফরাজিকান্দা এলাকায় ৬৬ শতাংশ জমি ও বাজার দখলের চেষ্টা চালায়। এ সময় জমির মালিক পক্ষের লোকজন ও এলাকাবাসী তাদের বাধা দিলে আজমেরী ওসমানের ক্যাডারদের গুলিতে জমির মালিক মঈনুল পারভেজ ও তার স্ত্রী গুলিবিদ্ধসহ ১৫ জন আহত হন। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর ধাওয়ায় আজমেরী ওসমানের সহযোগীদের ফেলে যাওয়া দুটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন স্থানীয়রা। কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেন তারা। ওই ঘটনার ২০ দিন পর
চিকিৎসাধীন অবস্থায় গুলিবিদ্ধ মঈনুল হক পারভেজের মৃত্যু হয়।
সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন জেলা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান। তিনি বলেন, ‘কাউকে অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়ার ব্যাপারে সরকারকে আবেদনকারীর সব দিক যাচাই বাছাই করতে হবে। অস্ত্রের অপব্যবহার হবে কিনা সেটাও বিবেচনা করতে হবে। কারণ যার তার হাতে অস্ত্রের লাইসেন্স গেলে সেটার অপব্যবহার হতে পারে। দেশ ও জনগণ হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। আমি মনে করি রাজনৈতিক পরিচয়ের কাউকে অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া উচিত না। এছাড়া একাধিক ফৌজদারি মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়াও আইনসম্মত না।’
আজমেরী ওসমানের অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদনের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক ও নিহত ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বলেন, ‘আজমেরী ওসমান নারায়ণগঞ্জের সর্বত্র খুনি, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ হিসেবে পরিচিত। ত্বকী হত্যা মামলায় গ্রেফতার আসামিদের দেয়া জবানবন্দিতে ঘাতক হিসেবে তার নাম এসেছে। চাঁদা আদায়ের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের ধরে এনে আজমেরী ওসমানের টর্চার সেলে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হতো। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব খবর প্রকাশও হয়েছে।’ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি আরও বলেন, ‘ত্বকী ছাড়াও সংস্কৃতি কর্মী ভুলু, চঞ্চল, মিঠু ও আশিকের হত্যাকারী হিসেবে এই আজমেরী ওসমানের নাম এসেছে। তিনি অস্ত্রের লাইসেন্স পেলে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায়
ভুগবে। এর পাশাপাশি দেশ খুনি, জল্লাদ ও সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়বে।
তাই সরকার যেন বিষয়টি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেন।’ এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ বলেন, অস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য যে কেউ আবেদন করতে পারেন। তবে লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু আইনগত শর্ত আছে। তার নামে কোন মামলা আছে কিনা, তিনি আর্থিক সামর্থ্যবান কিনা এবং তার অস্ত্রের প্রয়োজন আছে কিনা সে বিষয়গুলো যাচাই বাচাই করতে হয়।
যাচাই বাচাই শেষে এর প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। লাইসেন্স দেয়া বা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।