‘পরিস্থিতি এমন থাকলে না খেয়ে মরতে হবে’

‘পরিস্থিতি এমন থাকলে না খেয়ে মরতে হবে’

প্রথম নিউজ, নারায়ণগঞ্জ: সারাদেশের অন্য ব্যবসায়ীদের মতো অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন নারায়ণগঞ্জের থান কাপড়ের ব্যবসায়ীরা। লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেও গত ছয়মাসে কোনো লাভের মুখ দেখেননি তারা। এমনকি ন্যূনতম বনিবাট্টা পর্যন্তও করতে পারেন না। এতে অনেকেই দোকানপাট বন্ধ করে পার করছেন অলস সময়।

জানা গেছে, সব ধরনের গেঞ্জির থান কাপড়ের অন্যতম পাইকারি ও খুচরা বিক্রির মার্কেট হলো নারায়ণগঞ্জের ২ নম্বর রেলগেইট এলাকার রেলওয়ে সুপার মার্কেট। মার্কেটের পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন জায়গায় তাদের দোকান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আগে এই ব্যবসাটা অল্প পুঁজিতে করা গেলেও এখন আর অল্প পুঁজিতে ব্যবসা করা যায় না। যার ঘরে মাল নেই সে ঘরেও কমপক্ষে ১০ লাখ টাকার মাল থাকে। এমনও ঘর আছে যেখানে দুই থেকে চার কোটি টাকার মাল রয়েছে।

এখান থেকে নারায়ণগঞ্জের শিল্প নগরী বিসিকসহ বিভিন্ন এলাকার গার্মেন্টস মালিকরা থান কাপড় সংগ্রহ করেন। এরপর তারা এসব কাপড় নিয়ে তাদের কারখানায় গেঞ্জি, টি-শার্টসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করেন। পরবর্তীতে এসব পণ্য সৌদি আরব, দুবাই, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে থাকেন। একই সঙ্গে এসব পণ্য আবার দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ছয়মাস ধরে তাদের এই মার্কেটে ক্রেতার আনাগোনা একেবারেই কমে গেছে। আগে ব্যবসায়ীরা যেখানে দিনে ৪০ থেকে ৫০ হাজার পাউন্ড মাল বিক্রি করতেন সেখানে এখন মাসে ৪ থেকে ৫ হাজার পাউন্ড মালও বিক্রি করতে পারছেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেলওয়ে সুপার মার্কেট ও সংশ্লিষ্ট প্রায় দেড় হাজার দোকান রয়েছে। আর এই দোকানগুলোর সঙ্গে ৮ থেকে ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান জড়িত। বর্তমানে তারা কেউ ভালো নেই। তাদের এখান থেকে যারা মালামাল নিয়ে থাকেন সেসব পার্টিগুলো বিদেশে মাল পাঠিয়ে ঠিকমতো টাকা পাচ্ছেন না। এলসি করতে পারছেন না ডলারের সংকটের কারণে। এছাড়া বৈশ্বিক কারণে বিদেশেও বেচা-কেনা খারাপ। এছাড়া সামনে নির্বাচন, দেশে অস্থির অবস্থা চলছে। এ সব কারণে সবার ব্যবসা বাণিজ্য খুবই খারাপ যাচ্ছে। এতে ব্যবসায়ী ও তাদের অধীনে থাকা শ্রমিকরা বিপাকে পড়েছেন। অনেক শ্রমিক আছে তারা যে টাকা খরচ করে এখানে আসেন সেই খরচটা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন না।

আল্লা রাখা এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. জামিল বলেন, দুই থেকে তিনমাস ধরে ব্যবসা খুবই খারাপ যাচ্ছে। সারাদিনে কোনো পার্টি আসে না। সপ্তাহ-দশদিন পরে পার্টি আসে তাও আবার বাকি নিতে চায়। ফলে কোনো বেচাকেনা হয় না।

সাজেদা এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. সাইফুল মাহমুদ সাকিব বলেন, এবছর আমাদের বেচাকেনা অনেক কমে গেছে। মালগুলো পোর্টে আটকে থাকে। ঠিকমতো শিপম্যান্ট করতে পারছেন না। যার কারণে টাকাও আসছে না। এলসির সমস্যা রয়েছে। মেসার্স আরিফ ট্রেডার্সের মালিক মো. মাসুম বলেন, আমাদের ব্যবসা একেবারেই খারাপ যাচ্ছে। পার্টিরা আসে না। ১০ থেকে ১৫ দিন চলে যায় কোনো বেচাকেনা হয় না। জানি না কবে এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে। ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের লোন পরিশোধ করতে পারছেন না। যদি এমন অবস্থা চলতে থাকে তাহলে ব্যবসায়ীদের না খেয়ে মরতে হবে।

এম এস মারুফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. জোনায়েদ হোসাইন বলেন, সারাবিশ্বেই ব্যবসার সমস্যা হচ্ছে। আমাদের গার্মেন্টস শিল্প নির্ভর করে বাহিরের বায়ারদের ওপরে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাহির থেকে কোনো বায়ার অর্ডার দিচ্ছেন না। গার্মেন্টসের ওয়েস্টিজ মালগুলো আমাদের এই মার্কেটে আসে। কিন্তু ৫ থেকে ৬ মাস ধরে ওয়েস্টিজ মালগুলো কম নামছে। এজন্য আমাদের ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা খুবই খারাপ। আগে প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিন টন মাল বিক্রি হতো। এখন প্রতি মাসেও দুই থেকে তিন টন মাল বিক্রি হয় না। বন্ধু এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. রিটন মিয়া বলেন, ব্যবসায়ীরা দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই দোকান বন্ধ করে ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন। দিনদিন সুতার দাম বেড়েই চলছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখাটা কষ্টকর হয়ে যাবে।

মেসার্স ইয়া আলী এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. ফিরোজ মাহবুব বলেন, বর্তমানে আমাদের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। আমাদের এখানে মালগুলো সৌদি, দুবাই, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যায়। এখান থেকে কাপড় নিয়ে তৈরি করে সেসব দেশে পাঠানো হয়। এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাজার তেমন ভালো না। সামনে নির্বাচন। দেশের পরিস্থিতিও ভালো না। বিভিন্ন বিষয় মিলিয়ে আমাদের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। আগে সপ্তাহে ৪০ থেকে ৫০ হাজার পাউন্ড মাল বিক্রি করতে পারতাম। এখন মাসেও ৪ থেকে ৫ হাজার পাউন্ড বিক্রি করতে পারি না।

এম আর ট্রেডার্সের মালিক মো. মাসুদ পারভেজ বলেন, আমাদের থান কাপড়ের ব্যবসার খুবই বাজে অবস্থা। বছরজুড়ে মোটামুটি ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু তিনমাস ধরে আমাদের ব্যবসার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। গার্মেন্টসের ওয়েস্টিজ কাপড়গুলো সারা বাংলাদেশ থেকেই এখানে আসে। আমাদের এখান থেকে বিসিকসহ আশপাশের কারখানাগুলো কিনে নিয়ে গেঞ্জিসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে সৌদি দুবাই মালয়েশিয়া ফিলিপাইনসহ এসমস্ত দেশগুলোতে পাঠায়। কিন্তু বর্তমানে এসব পার্টিগুলো বিদেশে মাল পাঠিয়ে ঠিকমতো টাকা পাচ্ছে না। এলসি করতে পারছে না ডলারের সংকট রয়েছে ইত্যাদি নানা কারণে বিদেশের বেচাকেনাও খারাপ। দেশে অস্থির অবস্থা চলছে সামনে নির্বাচন। একারণে সবার ব্যবসা বাণিজ্য খুবই খারাপ যাচ্ছে।

রেলওয়ে সুপার মার্কেট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মনজুর হোসেন  বলেন, কাপড়ের ব্যবসার জন্য আমাদের এ এলাকা সবার কাছে পরিচিত। এই ব্যবসা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহযোগিতা করে থাকে। এখান থেকেই মালামাল নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়ে থাকে। ব্যবসার পরিস্থিতি বর্তমানে খুবই খারাপ। এমনও ব্যবসায়ী আছেন যারা ১৫ দিনেও কোনো বেচাকেনা করতে পারেন না। লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ব্যবসা করছে। কিন্তু সে তুলনায় কোনো বেচাকেনা হয় না। অনেকে নিয়মিত দোকানেই আসেন না। কারণ দোকান খুললেই খরচ।

রেলওয়ে সুপার মার্কেট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শুধু নারায়ণগঞ্জেই নয় সারাবিশ্বেই ব্যবসার মন্দা চলছে। সামনে নির্বাচনের কারণেও এটা হতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধের একটা প্রভাব আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগও ব্যবসার মন্দাভাবের কারণ হতে পারে। প্রায় ছয়মাস ধরেই ব্যবসার মন্দাভাব চলছে। নারায়ণগঞ্জে থান কাপড় ব্যবসার সঙ্গে ৬ থেকে ৭ হাজার জন জড়িত রয়েছে। বর্তমানে কোনো বেচাকেনা নেই। ব্যবসায়ীদের সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে। ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও এই মন্দাভাব রয়েছে। আশা করি এই মন্দাভাব হয়তো বেশিদিন থাকবে না।