সতর্ক মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নতুন মুদ্রানীতির কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে।

প্রথম নিউজ, অনলাইন: আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) শর্তসহ নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে আগামী অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের সতর্ক মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী রোববার বিকাল ৩টায় এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নতুন মুদ্রানীতির কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এতে আইএমএফ শর্তের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ওপর বেশি গুরুত্ব থাকবে। এ ছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে করিডর প্রথার আওতায় তা বাজারভিত্তিক করা, বাজারে অর্থের জোগান নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির অপারেটিং টার্গেট হিসেবে সুদকে বিবেচনায় নেয়া, টাকা ও ডলারের একক বিনিময় হার চালু এবং রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়নের ঘোষণা দেয়া হবে মুদ্রানীতিতে। সেই সঙ্গে রিজার্ভ সাশ্রয়ে নেয়া পদক্ষেপ অব্যাহত রাখারও ঘোষণা দেয়া হবে।
জানা গেছে, এবারের মুদ্রানীতিকে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বান্ধব এবং মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক নীতি অনুসরণ করা হবে। বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে নজর দেয়া হবে। এজন্য কিছু খাতে প্রণোদনা অব্যাহত রাখা হবে। সূত্র জানায়, আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী চলতি জুনের মধ্যে আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী মুদ্রানীতিতে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা থাকবে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের গ্রস হিসাব প্রকাশ করলেও জুলাই থেকে রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করা হবে। এর মাধ্যমেই আইএমএফ’র আরও একটি শর্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে।
আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার, ডলারের একক দর নির্ধারণ ও ঋণের সুদের হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে না। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আংশিক নিয়ন্ত্রণ থাকবে। ডলারের দাম বৈদেশিক মুদ্রা বেচাকেনার লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলোর নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স এসোসিয়েশনের (বাফেদা) মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। যেটি এখনো হচ্ছে। এটি একেবারে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে যে ডলার বিক্রি করে সেটির দরও বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারণ করবে।
তবে বাজার দরের সঙ্গে ব্যবধান কমিয়ে আনা হবে। বর্তমানে ডলারের হরেক রকম দর প্রচলিত রয়েছে বাজারে। সেগুলোকে একক একটি দরে নিয়ে আসার শর্ত রয়েছে আইএমএফ’র। এটি নিয়ে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যে কারণে এটি এখনই সম্ভব হচ্ছে না। আপাতত ডলারের বিভিন্ন উপকরণের বিভিন্ন দর থাকবে। পর্যায়ক্রমে ডলার ক্রয় ও বিক্রয় মূল্য দর কাছাকাছি নিয়ে আসা হবে।
ঋণের সুদের হারের ৯ শতাংশের সীমা তুলে দেয়া হবে। তবে সুদের হার একেবারে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে না। লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফার রেটের (লাইবর) মতো এখানেও ৬ মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে ৩ শতাংশের একটি ক্যাপ দেয়া হবে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো সুদের হার ট্রেজারি বিলের সুদের হারের চেয়ে ঋণের সুদ ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারবে। আইএমএফ’র আরও একটি শর্ত ছিল- চলতি জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ নবায়ন ও খেলাপি ঋণের তথ্য বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে প্রকাশ করার পদক্ষেপ নেয়া। সেটির ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদক্ষেপ নিচ্ছে। খেলাপি ঋণ কমানোর শর্তও রয়েছে তাদের।
এরমধ্যে সরকারি ব্যাংককে ১০ শতাংশ ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা। সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের অনেক উপরে রয়েছে। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশির ভাগেরই খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। শর্ত অনুযায়ী এ প্রক্রিয়াটি ২০২৬ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। এবারের মুদ্রানীতিতেও খেলাপি ঋণের বিষয়ে কড়া কথাবার্তা থাকবে।
মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণের জন্য টাকার প্রবাহে লাগাম টানা হবে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, মুদ্রানীতি ব্যবহার করে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, এমন কি ভারত মূল্যস্ফীতির হারকে বাগে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ পারছে না। কারণ এখানে বাজারে কারও নিয়ন্ত্রণ নেই।
চলতি অর্থবছরে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ৩৭.৭ শতাংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত বেড়েছে ২৫.৩৬ শতাংশ। বছর শেষে এ খাতেও ঘাটতি থাকবে। ডলার সংকটে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সরকারি ঋণ বাড়েনি। চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ১৪.১ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। জুলাই-এপ্রিলে বেড়েছে ৭.৮৬ শতাংশ। এতেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। কারণ বেসরকারি খাত দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তায় ভুগছে।