মুন্সীগঞ্জে গ্রামছাড়া অর্ধশতাধিক পরিবার

আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের দ্বন্দ্বে অনাবাদি ৩ হাজার শতাংশ জমি

মুন্সীগঞ্জে গ্রামছাড়া অর্ধশতাধিক পরিবার
মুন্সীগঞ্জে গ্রামছাড়া অর্ধশতাধিক পরিবার

প্রথম নিউজ, মুন্সীগঞ্জ: মুন্সীগঞ্জ সদরের চরাঞ্চল চরকেওয়ার ইউনিয়নে  আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের বিরোধে হামলা-মামলার জেরে ৬ মাস ধরে ৬০টি পরিবারের দুই শতাধিক লোকজন গ্রামছাড়া থাকার অভিযোগ উঠেছে। সহিংসতার পরিবেশ থাকায় ভয়ে চলতি আলু আবাদি মৌসুম শেষ হতে চললেও নিজেদের ৩ হাজার শতাংশ জমি অনাবাদি ফেলে  রেখেছেন বলে দাবি ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা বন্ধ রয়েছে শিক্ষার্থীদের।  অভিযোগ উঠেছে, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জেলা পরিষদ সদস্য আক্তারুজ্জামান জীবন সমর্থিত মামুন হাওলাদার পক্ষের লোকজনের সঙ্গে বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আফসার উদ্দিন ভুইয়া সমর্থিত আহম্মদ হোসেন পক্ষের লোকজনের সংঘর্ষের জের ধরে ভুক্তভোগীদের এলাকায় ফিরতে দিচ্ছে না প্রভাবশালী মামুনের পক্ষের লোকজন।

এ নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গরা উভয়পক্ষ নিয়ে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে দফায় দফায় আপস-মীমাংসার চেষ্টা করলেও এখন পর্যন্ত কোনে সমাধান হয়নি। স্থানীয়রা জানান, গত ইউপি নির্বাচনে চরকেওয়ার ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ছিলেন আফসার উদ্দিন ভুইয়া। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন আক্তারুজ্জামান জীবন। নির্বাচনের আগে জীবন আফসার উদ্দিন ভূইয়াকে সর্মথন দিলেও দু’টি পক্ষের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১০ই জুলাই ঈদুল আযহার পরদিন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খাসকান্দি ও ছোট মোল্লাকান্দি এলাকায় সংঘর্ষে জড়ায় দু’পক্ষ। ঘটনার সময় গুলিবিদ্ধ হয় উভয়পক্ষের অন্তত ১০ জন।

এ সময় মামুন পক্ষের খাসকান্দি এলাকার মৃত বাচ্চু মুন্সির ছেলে রবিউল ইসলাম (১৮) বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। পরবর্তীতে তার বাম পায়ের নিচের অংশ কেটে ফেলতে হয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে মুন্সীগঞ্জ সদর থানায় আহম্মদ পক্ষের ৫১ জনকে আসামি করে মামলা করেন মামুন পক্ষের লোকজন। মামলার পর থেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবারসহ এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এজাহারে থাকা ৫১ জন আসামিসহ অন্তত ৬০ জন ও তাদের পরিবারের দুই শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। গ্রামছাড়া এই পরিবারগুলো বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ফেলে আসা ঘরবাড়িতে থাকা টিউবওয়েল, ফার্নিচার, জানালার গ্রিল, মটর ইত্যাদি খুলে নিয়ে গেছে প্রতিপক্ষ মামুন হাওলাদারের লোকজন। এমনকি তাদের ফেলে আসা আবাদি জমিগুলোও পড়ে আছে অনাবাদি অবস্থায়।

ভুক্তভোগীদের তথ্যমতে অনাবাদি জমিগুলো হলো- খাসকান্দি এলাকার গিয়াসউদ্দিন বেপারির ১২৬০ শতাংশ, আহম্মদ হাওলাদারের ৮০০ শতাংশ, আজাহার মোল্লার ১ একর, মজিবর বেপারির ৫০ শতাংশ, মজনু হাওলাদারের ৮০ শতাংশ, হালেম বেপারির ৪০ শতাংশ, মজিবর হাওলাদারের ২ একর, ছোট মোল্লাকান্দি এলাকার সৈয়দ খার ৪৮০ শতাংশ, উকিল গাজীর ৮০ শতাংশ, মোতালেব দেওয়ানের ৪০ শতাংশ ও রফিক সিকদারের ৮০ শতাংশ। সরজমিন গত সোমবার দেখা যায়, পার্শ্ববর্তী জমিতে আলুর গাছ বড় হতে থাকলেও অনাবাদি বিস্তীর্ণ জমি। স্থানীয় হোসেন হাওলাদারের স্ত্রী রোকেয়া বেগম (৩০) জানান, আগে আমাদের গ্রামে এত ঝগড়াঝাটি ছিল না। আলু লাগানোর মৌসুম প্রায় শেষ পর্যায়ে। আর মাত্র ১০ দিনের মধ্যে আলু না লাগালে এই জমিগুলো এভাবেই পড়ে থাকবে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম হাওলাদার বলেন, সর্বশেষ চরকেওয়ার ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধের শুরু হয়। এরপর আমি দুই গ্রুপকে মিলেমিশে থাকার জন্য বারবার বলি। কিন্তু কেউই শুনেনি। সম্প্রতি আমরা উভয়পক্ষের লোকজনসহ পুলিশের উপস্থিতিতে বসি। সেখানে মামুন গ্রুপের পক্ষ থেকে গুলিবিদ্ধ রবিউলসহ আহতদের চিকিৎসা বাবদ ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু পরে আর এ নিয়ে আপস-মীমাংসা হয়নি। অভিযোগের বিষয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মামুন হাওলাদার বলেন, আমার গ্রামের বাড়ি ছোট মোল্লাকান্দি হলেও আমি ঢাকায় বসবাস করি। বেশ কয়েকবছর ধরেই স্থানীয় দু’পক্ষের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ চলে আসছে। সংঘর্ষের ঘটনায় অনেকের অঙ্গহানিও ঘটেছে। জমিতে চাষাবাদ যারা করতে পারেনি তারা ভয়ে নিজেরাই এলাকায় আসছেন না।

তারা কেন আসছেন না আমার জানা নেই। যারা জমিতে চাষাবাদ করতে পারেনি, তারা আসলে আমি প্রয়োজনে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের চাষাবাদে সহায়তা করবো। তিনি বলেন, আর যার পা চলে গেছে তারা খুব ক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে। তাদের ভয়ে ওই পক্ষের লোকগুলো নিজেরাই আসে না। চরকেওয়ার ইউপি চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন ভুইয়া বলেন, চরকেওয়ার ইউনিয়নের খাসকান্দি ও ছোট মোল্লাকান্দি এলাকার দীর্ঘদিনের বংশগত বিরোধের জের ধরে এখানে প্রায়ই সহিংস ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ নির্বাচনের সময় এই বিরোধ আরও চরম আকার ধারণ করে। আমি নৌকা প্রতীক পেলে আহম্মদরা আমার পক্ষে কাজ করে। অন্যদিকে মামুনরা স্বতন্ত্র প্রার্থী আক্তারুজ্জামান জীবনের পক্ষ হয়ে নির্বাচন করে। দুই পক্ষেরই অন্তত ১৫-১৫টি করে ৩০টি মামলা রয়েছে।

তবে এই এলাকায় যাই ঘটুক মামুনের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো মামলা নেয় না। পুলিশের এক বড় কর্মকর্তা মামুনের বোন-জামাই। যার জন্য সে ঘটনার সাথে জড়িত থাকলেও তাকে মামলার আসামি করা হয় না।  জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অর্থ ও প্রশাসন) সুমন দেব বলেন, মামুন হাওলাদার কার আত্মীয় সেটি আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। বাংলাদেশ পুলিশের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও আমাদের বলেনি সে কারও আত্মীয়। থানায় তার বিরুদ্ধে কেন মামলা হয় না সেটি এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে সে প্রকৃত অপরাধী হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই মামলা নেয়া হবে।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom