অপরাজেয় পুতিন: শৈশবের লড়াই থেকে ক্রেমলিনের কর্ণধার

প্রথম নিউজ, অনলাইন: রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের শৈশব কেটেছে লেনিনগ্রাদের (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) একটি জরাজীর্ণ ফ্ল্যাটে। ছোট বেলায় পুতিন ও তার বন্ধুরা মিলে ইঁদুর তাড়া করে বেড়াতো। একবার একটি বিশাল ইঁদুর তাকে উল্টো তাড়া করেছিল। সেই ঘটনার কথা স্মরণ করে পুতিন বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা হওয়ার মানে আমি সেদিন বুঝেছিলাম।
এই একটি ঘটনাই যেন প্রতীক হয়ে উঠেছে তার পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনের। ক্রেমলিন পর্যবেক্ষকদের মতে, তিনি নিজেকে একটি কোণঠাসা ইঁদুরের মতো ভাবেন, যাকে টিকে থাকতে হলে আঘাত করতে হবে।
১৯৫২ সালে জন্ম নেওয়া পুতিনের শৈশব ছিল সংগ্রামময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বেড়ে উঠা, বাবা-মায়ের দূরত্ব ও দুর্বল স্বাস্থ্য তাকে গড়ে তুলেছিল এক ধীর-নিরবধি যোদ্ধা হিসেবে।
তিনি কিশোর বয়সেই জুডো এবং সাম্বো শেখা শুরু করে শারীরিক শক্তির অভাব মেটাতে আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করেন।
পুতিনের দীর্ঘদিনের বন্ধু ও জুডো পার্টনার আর্কাদি রোতেনবার্গ, পরবর্তীতে তার একনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠেন। শৈশবে জার্মান ভাষায় পারদর্শী হওয়ার কারণে পুতিন কেজিবি-তে যোগ দেন।
বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পড়া ও সোভিয়েত পতনের সময় ড্রেসডেনে অবস্থান করছিলেন পুতিন।
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কীভাবে এক মুহূর্তেই একটি সরকার ভেঙে পড়তে পারে। সেই অভিজ্ঞতা তাকে ক্রমেই জনবিপ্লব ও গণআন্দোলনের প্রতি অবিশ্বাসী করে তোলে।
দেশে ফিরে সেন্ট পিটার্সবার্গের মেয়র আনাতোলি সোবচাকের অধীনে কাজ শুরু করেন পুতিন, এবং ধীরে ধীরে মস্কোয় চলে এসে তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের আস্থা অর্জন করেন।
১৯৯৮ সালে তিনি রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি-এর প্রধান হন, পরে ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন।
চেচনিয়া বিদ্রোহ দমনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে পুতিন রাশিয়ানদের মাঝে জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
তার দৃঢ় নেতৃত্বে বিশ্বাস জন্মায় সাধারণ মানুষের মধ্যে। যার প্রভাব পড়ে ২০০০ সালের নির্বাচনে, সে বার বিপুল ভোটে জয়ী হন তিনি।
ক্ষমতায় এসে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ধনী অলিগার্চরা রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করলে রেহাই পাবেন না। মিখাইল খোদরকভস্কির মতো ধনকুবেরদের গ্রেফতার করে তার বার্তা ছিল স্পষ্ট, ‘আমিই রাশিয়ার নিয়ন্ত্রক’।
প্রথমদিকে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করলেও, ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ এবং ২০০৪ সালে ইউক্রেনের অরেঞ্জ রেভল্যুশন তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়।
তিনি পশ্চিমা বিশ্বের নীতিকে ‘হস্তক্ষেপমূলক’ ও ‘অবিশ্বাসযোগ্য’ হিসেবে দেখতে শুরু করেন।
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল এবং ২০২২ সালের ইউক্রেন আক্রমণের মধ্য দিয়ে তার ভিশন আরও পরিষ্কার হয়। তিনি রাশিয়াকে আবারও এক ‘মহাশক্তি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, যে কোনও মূল্যে।
৭২ বছর বয়সেও পুতিন ক্ষমতার শীর্ষে। তাকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা সাবেক রাজনীতিকরা বলছেন, ‘তিনি এখনো সেই স্কুলের ছেলেটিই, যে প্রতিদিন প্রমাণ করতে চায় যে সে সবচেয়ে শক্তিশালী।’
রাশিয়ার ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে একজন মানুষের উপর, যিনি নিজেকে রাশিয়ার রক্ষক ভাবেন।
২৫ বছর পরও পুতিনের রাজনৈতিক যাত্রা শেষ হয়নি। তবে সামনে কী অপেক্ষা করছে, বিশ্বব্যাপী শান্তিপূর্ণ সমঝোতা, নাকি আরও সংঘাত? সময়ই দেবে তার উত্তর।